শুভায়ু বন্দ্যোপাধ্যায়

বাগদাদে ফ্রাঙ্কেন্সটাইন – আহমেদ সাদাওয়ির আধুনিক ফ্যান্টাসি গল্প

শুভায়ু বন্দ্যোপাধ্যায়

ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল ২০১৮ সালের শর্টলিস্টে সবচেয়ে সাড়া জাগানো বইয়ের নাম ‘ ফ্রাঙ্কেন্সটাইন ইন বাগদাদ’। ব্যাপারটা একবার চিন্তা করলে আষাঢ়ে গল্প মনে হয় – এক্কেবারে আষাঢ়ে গল্পই। বাগদাদে তখন ঘুরে বেড়াচ্ছে আমেরিকান সৈন্যরা, ব্রিটিশ সৈন্যরা, ইরাকি রেজিস্ট্যান্স গ্রুপ্স আর ফ্রাঙ্কেন্সটাইনের দৈত্যের মতো দৈত্য। বাগদাদে ফ্রাঙ্কেন্সটাইনের উপর লেখা নিয়ে প্রথমেই পশ্চিমই দুনিয়ায় একটা অবহেলা দেখা যায়- ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি যখন ২০১৪ সালে আহমেদ সাদাওয়ি পান আন্তর্জাতিক আরবি উপন্যাস পুরস্কার।

ফ্রাঙ্কেন্সটাইন ইন বাগদাদ আরম্ভই হচ্ছে এক বিস্ফোরণ দিয়ে- এরকম বিস্ফোরণের কথা প্রায়ই আমরা খবরের কাগজে পড়ি- বছর কয়েক আগে মন নাড়া দিতো অসহায় নির্দোষ সাধারণ মানুষের মৃত্যু, এখন আর নাড়া দেয় না, পাতাটা উলটে খেলার পাতায় চলে যাই। কিন্তু যে মানুষগুলো মরে গেলো, তাদের বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনদের কি হল? তারা হয়তো প্রাথমিক শোক কাটিয়ে ওঠার পর চায় অন্তত একটা কবর থাকুক প্রিয়জনের, কিন্তু কবরের জায়গা থাকলেও অনেক সময়েই পুরো শরীরটা পাওয়া যায় না- অনেক সময় শনাক্তই করা যায় না। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকে হামার জীপে টহল দেয় মার্কিন সেনা আর রাস্তায় আবর্জনার মতো পড়ে থাকে মৃতদেহ। লোকজন, যারা পালাতে পেরেছে তারা পালিয়েছে, আর যারা পালাতে পারেনি, তারা বন্ধুবান্ধবহীন একাকীত্বের জীবন যাপন করছে।

সেইরকমই একা একটা মানুষ হাদী আল আতাগ। পুরনো জিনিসবিক্রেতা। মদ্যপ, গুলবাজ হাদীর শরীর থেকে মদ আর সিগারেটের কটু গন্ধই ভেসে আসে। যেখানে বোমা ফাটে সেখানেই সে ছুটে যায় আর তুলে আনে নানা রকম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। আর সেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো সেলাই করে সে তৈরি করছে এক পুর্নাঙ্গ মানুষ, যে মানুষকে সে এক সভ্যমানুষের মতো কবর দিতে পারবে। একটা নাক পাওয়া যাচ্ছে না- সেটাও সে পেয়ে গেলো পরের বিস্ফোরণে।

এই দানব আচমকা প্রাণও পেয়ে যায়। বেরিয়ে যায় বাগদাদের রাস্তায় অন্যায়ের শাস্তি দিতে, অনেকটা অমিতাভ বচ্চনের শাহেনশাহর মতো আর কি। নিজের হাতে আইন তুলে দুর্জনদের শাস্তি দিতেই হবে তাকে- তার বিবেক তো সেরকমই বলে। স্বভাবতই এবার শুরু হল চুড়ান্ত কনফিউশন। “ সদর সহরে তাকে বলা হল ওয়াহাবি, আদামিয়াতে শিয়া চরমপন্থী। আর আমেরিকানরা ধরেই নিল যে সে এক ইরাকি বিপ্লবী যার উদ্দেশ্যই হল আমেরিকানদের এই মহান কর্মযজ্ঞ পণ্ড করা।”

কিন্তু এই দানবের শরীর থেকে যখন এক এক করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো পচে খসে খসে পড়তে লাগলো, তখন তার ন্যায়ের চিন্তার বদলে এলো খুনের চিন্তা – ওই অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো তার লাগবে তো! সেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো তাকে ফিরে পেতে হবে যে।

এটা কি ভয়ের গল্প? লোকের মনের ভয় মিলেমিশে এই মিথ তৈরি হয়েছে? কিছু সমালোচক এরকমই মনে করেন- আর মনে করা স্বাভাবিকই। ঠিক এই ভয় বা রাগের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই আমাদের হিন্দি সিনেমার দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালনে- সিনেমার বাস্তবতার চিন্তা আমাদের মনে আসে না- নায়ক একাই একশোজনকে মারধর করে আমাদের ক্ষোভ প্রশমিত করার জন্যে। আর মার্কিন সেনাদের টহলের মাঝে, আল কায়দার হৃদয়হীন হত্যালীলার মাঝে, আইসিসের ধ্বংসের উন্মত্ততার মাঝে ক্ষুধার্ত, শান্তিপ্রিয় ইরাকিদের ভয়, ক্রোধের বহিঃপ্রকাশে যে এই দানবের সৃষ্টি হবে তা পাঠককে বিস্মিত করে না। সঙ অফ সলোমন-এ টনি মরিসন বলছেন “what difference does it make if the thing you scared of is real or not?”

স্যাটায়ার আর রুদ্ধশ্বাস ভয়ের এবং হাসির গল্প আমাদের আজকের ইরাকের সঙ্গে পরিচয় করায়। এ এক একেবারে নতুন ফ্রাঙ্কেন্সটাইন। বিখ্যাত আমেরিকান সমালোচক স্যাম মেটজ লিখছেন “ As this emotionally sensitive corpse monster –the first authentic iraqi, by way of amateur suturing, roams a city where reality has become stranger than fiction,vigilate trials offer readdress a glimpse of Iraq that can not be gleaned from traditional war-reporting or policy memos.”

আহমেদ সাদাওয়ি গল্প বলেছেন, আর তা বলেছেন যথেষ্ট মুনশিয়ানার সঙ্গে। পাঠক কে ভাবতে বাধ্য করেছেন যে এটা কি যুদ্ধপরবর্তী ইরাকের প্রতিচ্ছবি নাকি সম্পূর্ণ ফ্যান্টাসি। ধীরে ধীরে পাঠক পৌঁছে যায় এক অদ্ভুত ছন্নছাড়া জগতে যেখানে একদিকে রয়েছে অনর্থক হানাহানি, রয়েছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আবার রয়েছে অবাস্তব নৈতিকতা আর সাধারণ মানুষের ক্ষোভ। বিখ্যাত লেখক সারা পেরি গার্ডিয়ান পত্রিকায় ঠিক এই কথাটাই লিখছেন। যে ইরাক ছিল উন্নত, স্বাধীন এবং যথেষ্ট সহনশীল, সেই ইরাক হয়ে উঠল নীতিহীন, অরাজকতা, প্রতিহিংসাপরায়ণতার স্বর্গরাজ্য।

অবশ্যই সমালোচকদের ভুল হয়নি এই উপন্যাসের নতুনত্ব বিচার করতে। ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল ২০১৮ এর শর্টলিস্টে থাকে এই বই।

বাগদাদে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন -এর লেখকের একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার নেওয়া গেল এডিনবরা বইমেলায়।

লেখক : বইটির পটভূমিকা সম্বন্ধে একটু বলুন।

সাদাওয়ি : আমেরিকার ইরাক আক্রমণ ইরাকের ইতিহাসে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং troubled অধ্যায়। লক্ষ লক্ষ লোক মারা গেছে এই যুদ্ধে। প্রতিটি মৃত্যু আমাকে কষ্ট দিয়েছে, প্রতিটি প্রিয়জনের কান্না আমাকে ব্যথিত করেছে, রাগ হয়েছে সবার মতো, আমারও। এতোগুলো অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ এই বই।

লেখক: বাগদাদের রাস্তায় দানব! আজগুবি নয়?

সাদাওয়ি: হাঃ হাঃ হাঃ, আসলে আমার এই দানবের জন্মই হল বিভিন্ন লোকের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে। অর্থাৎ আমার লেখায় যা আমি বোঝাতে চেয়েছি যে আমরা সকলেই কোন না কোনভাবে জড়িয়ে পড়েছি এই যুদ্ধে- এই অগুনতি মানুষের মৃত্যুতে আমাদেরও কোন না কোনভাবে একটা ভূমিকা থেকে যায়। ঠিক এই কথাটাই বলতে চেয়েছি আমার এই দানব সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে। আর গল্প এগিয়ে নিয়ে যেতে এই প্লট খুব সাহায্য করেছে – লোকের কাছে যেন এই যুদ্ধ, মৃতদেহের মিছিল খুব স্বাভাবিক হয়ে পড়ছিল- সেখানে আমার এই প্রটাগনিস্ট তাদের এই দুঃখ, রাগকে প্রকাশের একটা পথ করে দিয়েছে।

লেখক: কিন্তু যুদ্ধটা কি দরকারি ছিল?

সাদাওয়ি: সে বিচার করতে চাই না- যুদ্ধ হয়েছে সেটা বাস্তব আর সেকথাই লিখেছি আমি। সবাই দেখেছে অপর পক্ষের দোষ – নিজের দোষটা দেখলে হয়তো যুদ্ধটাই হতো না।

লেখক: ফ্রাঙ্কেন্সটাইন ইন বাগদাদ কি তাহলে একটা ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস?

সাদাওয়ি: আমার পাল্টা প্রশ্ন, বাস্তবই যদি ডিস্টোপিয়া হয়? ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস সাধারণত ভবিষ্যতের কথা বলে কিন্তু এই উপন্যাসে আমি অতীত এবং বর্তমানের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ভবিষ্যৎকে দেখিয়েছি। এটা শুধু ইরাক নয়, গোটা পৃথিবীর যেকোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ছবি। এই সব দেশে কোন নিরপরাধ লোকই সম্পূর্ণ নিরপরাধ নয় আবার কোন অপরাধীই কিন্তু সম্পূর্ণ অপরাধী নয়- যে সব লোককে এই দানব খুন করেছে তারা আপাতদৃষ্টিতে অপরাধী হলেও, তারা কিন্তু নিজেরাও আক্রান্ত এমন কি ক্ষেত্রবিশেষে নিরপরাধ।

লেখক: যুদ্ধের উদ্দেশ্যটা কি পূরণ হয়েছে?

সাদাওয়ি: যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন উদ্দেশ্য একরকম থাকে। ধীরে ধীরে যত দিন কাটে, উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য (agenda and aim) বদলে যেতে থাকে। শেষে এমন একটা সময় আসে যখন যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্যটা একেবারে হারিয়ে যায় আর তার জায়গায় এক সম্পূর্ণ নতুন agenda তৈরি হয়। আর সেই agendaর সঙ্গে প্রাথমিক agenda-র কোন মিলই থাকে না। যুযুধান দুই পক্ষই বিস্মৃত হয় অথবা তারা জানেই না যে কেন তারা লড়াইটা লড়ছে আর কেই বা বিজয়ী হল আর কেই বা বিজিত। জয়ী কোনদিন জানলই না যে সে কি জিতল। একেবারে নিরপেক্ষভাবে আমার এটাই মনে হয়েছে।

আহমেদ সাদাওয়ির এই উপলব্ধিগুলো কিন্তু আমাদের ভাবতে বাধ্য করে যে যুদ্ধের ফলাফল বা গতিপ্রকৃতি কিন্তু ইতিহাস পড়ে বা যান্ত্রিক তথা কৌশলগত দিক দিয়ে সম্পূর্ণভাবে বিশ্লেষণ করা কঠিন। যুদ্ধের সবচেয়ে বেশী দাম চোকায় সাধারণ মানুষ। আহমেদ সাদাওয়ি বোমা, গুলি, মৃত্যু, মৃতদেহ দেখেছেন তাঁর শোবার ঘোরের জানলা থেকে- দূর থেকে দেখে মন্তব্য করেননি। দেশভক্তদের নিয়ে গান বাঁধেননি, বিশ্বাসঘাতকদের তুলোধোনাও করেননি। কমেডির ছলে বলেছেন মানুষের কথা, মৃত্যুর কথা, প্রিয়জন হারানোর শোকে প্রিয়জনদের হাহাকারের কথা।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
(এডিনবরা বইমেলায় নেওয়া সাক্ষাৎকার এই প্রবন্ধের লেখকের ব্যক্তিগত নোট থেকে উদ্ধৃত । ছবিটি নেট থেকে সংগৃহীত।)

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান